সে এক অচিন মাঝির খোঁজে

সে এক অচিন মাঝির খোঁজে


“মাঝি রে…
ধনরত্ন আর মালের ভাণ্ডার
যখনই সব ছিল আমার
আদর করতো দেশের দশজনায়।
এখন লাভেমূলে সবই খাইয়া
আমারে দেয় বিদায় দিয়া
আপন মানুষ পর হইয়া যায় রে দয়াল মাঝি
আমারে নি নিবা তোমার নায়।”

দোতরায় আঙুল চলে শীতলক্ষ্যার ঢেউয়ের মতন তিরতির করে। কণ্ঠে মধু নাই, আবেগ আছে। নয়া পাগলার এই আবেগ আমাকে টানে। তাই সুযোগ পেলেই কলেজের ক্লাস ফেলে সাইকেলে করে চলে আসি লক্ষ্যার তীরে। স্কুল-কলেজের বিদ্যাটুকু সুপারিখাপের মাচায় বিছিয়ে বসে পড়ি। ভদ্র সমাজের শ্রদ্ধাভক্তি, লাজলজ্জার ওপর পা-টা রেখে আসমানে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দিলে সব ধোঁয়া মেঘ হয়ে হৃদয়ে বৃষ্টি জমায়। ততোক্ষণে কাহারবা তালে দেহ নেচে ওঠে, চোখ বন্ধ হয়ে আসে। এক চৈত্র শুকিয়ে কাঠ হওয়া বৈশাখের তীব্র তৃষ্ণার্ত মাটির মতো বৃষ্টিদের চুষে নিই তখন।

“মাঝি রে…
মহাজনের ষোলো আনা
চালান খাইয়া হইছি দেনা
কী জবাব দিবো যাইয়া পারঘাটায়।
আমার সঙ্গের সাথী যারা ছিল
সুযোগ পাইয়া চলে গেল
এখন দেখি বেলা ডুবে যায় রে দয়াল মাঝি
আমারে নি নিবা তোমার নায়।”

মাঝি নেয় না কাউকে। একা চলে যায়। বাউলের দোতরা তখন এক অক্ষর দুই অক্ষর করে থেমে যেতে থাকে। একটা ডুবন্ত বেলাকে ঘাড়ে নিয়ে আমি তখন সাইকেলে করে ছুটতে থাকি। মৃদু অন্ধকার গাঢ়তর হয়। চারপাশে কেয়ামতের মাঠ। কী নীরব কী জনশূন্য কী অন্ধকার। অন্ধকারের কালো দুর্গন্ধ ছড়িয়ে যায় সবখানে। আমার কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে। গা গরম বাজারি ওয়াজিনে ক্বেরামের মেজাজের মতন। মাথায় পানি ঢালবার জন্য আমি চিৎকার করতে থাকি। কিন্তু কেয়ামতের শুনশান মাঠে আমার সব চিৎকার শূন্যের সাথে কোথায় মিলিয়ে যায়। মায়ের কানে পৌঁছায় না। মা কেবল আমার বাবার পাতে ডালভাত মেখে দিতে ব্যস্ত। ভদ্রলোক বহুদিন ধরে দুরারোগ্য ব্যাধিতে পড়ে নিজে নিজে চলতে না পারার, খেতে না পারার আর কোনো কথা বলতে না পারার এক শিল্পসম্মত অভ্যাসে পতিত হয়েছেন। তাঁর কিছু বলতে না পারার অভ্যাসটুকু আমার ভালো লাগে। সব কথা বলতে নাই। সব পথে চলতে নাই। এই দর্শনকে আমি তাঁর কাছ থেকে শিখে নিয়ে যুক্তিবিদ্যার ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়ি। রাতে চুরি করতে গিয়েছিলাম কিনা—শিক্ষিকার এ প্রশ্নের জবাবে আমি চুপ থাকি। বেরিয়ে যেতে বললে নিঃশব্দে বেরিয়ে যাই। কেননা দোতরায় নয়া পাগলার আঙুল চলে শীতলক্ষ্যার ঢেউয়ের মতন তিরতির করে। কণ্ঠে মধু নাই, আবেগ আছে। এই আবেগ আমাকে টানে। তাই সুযোগ পেলেই কলেজের ক্লাস ফেলে সাইকেলে করে চলে আসি লক্ষ্যার তীরে। স্কুল-কলেজের বিদ্যাটুকু সুপারি খাপের মাচায় বিছিয়ে বসে পড়ি। রাধাবল্লভের বাণী চলতে থাকে নিরক্ষর বাউলের কণ্ঠে—

“মাঝি রে…
রাধাবল্লভ বলে দয়াল মাঝি
তুমি যার ওপরে রাজি
অনায়াসে পার হইয়া যায়।
আমায় ঐ পার যদি নাহি নাও
সামনে আসিয়া দাঁড়াও
তোমায় দেখে প্রাণ যেন জুড়ায় রে মাঝি
আমারে নি নিবা তোমার নায়।”

মাঝি চলে যায়। আমি অপেক্ষায় থাকি আবার সে আসবে এই আশায়। তারপর বন্ধুহীন, আপনজনহীন কেয়ামতের মাঠে অন্ধকার কালো দুর্গন্ধ গিলতে গিলতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম না ভাঙার প্রার্থনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি।