সংসার : সঙ্গী নির্বাচনের এখতিয়ার

সংসার : সঙ্গী নির্বাচনের এখতিয়ার


মানুষকে মানুষ হিসেবে বিচার করার মাপকাঠি কী? বাহ্যিক সৌন্দর্য, নাকি ভেতরের নিষ্কলঙ্কতা? ব্যাপারটা এমন নয় যে, বাইরের সৌন্দর্য আর ভেতরের নিষ্কলঙ্কতা দুটো বিপরীতমুখী প্রকৃতি; অর্থাৎ একটা থাকলে আরেকটা থাকতে পারবে না। এমন অনেক মানুষ আছে, যারা বাইরে দেখতে যেমন সুদর্শন-সুশ্রী, ভেতরেও তেমনি সৎ-নিষ্ঠাবান-কোমলমতি। আবার দুদিক থেকেই চরম মাত্রায় ঘাটতি রয়েছে এমন মানুষও থাকতে পারে। তবে সাধারণত চারপাশে আমরা যাদের দেখি, হোক কাছের মানুষ কিংবা দূরের মানুষ, তাদের অনেকের মধ্যেই ভেতরে-বাইরের একটা বৈপরীত্য দেখা যায়। এমন কি এ তালিকায় আমরা নিজেদেরও হয়তো বাদ দিতে পারি না। তবুও বলতে হয়, এরকম মানুষের সংখ্যাই পৃথিবীতে বেশি।

এই ধরা যাক, পুরুষমানুষের কথাই যদি বলি, বিবাহযোগ্য পুরুষমানুষ। উচ্চতায় ছ’ফুটের কাছাকাছি বা তারও বেশি, স্বাস্থ্যবান-সুঠাম দেহের অধিকারী, দেখতে পরিপাটি-গুছানো—এমন পুরুষমানুষদের আমরা সুদর্শন বলি। বাবামায়েরা মেয়ের পাত্র হিসেবে তাদের যোগ্য বলে বিবেচনা করেন। আর সুদর্শন পাত্রটির অর্থসংস্থান যদি সন্তোষজনক হয় তবে তো কথাই নেই। তাকে লুফে নেবার জন্য গোপনে একটা প্রতিযোগিতাই হয়ে যায়। অথচ ভেতরে সে কতোটা সৎ, জ্ঞান-বুদ্ধি-প্রজ্ঞায়, চিন্তায়-চেতনায় কতোটা সে নির্ভরযোগ্য এবং তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পাত্রীর মনন-মানসিকতার সামঞ্জস্য কতোটুকু তা বুঝে ওঠার সুযোগও দেয়া হয় না, এতো কিছু বিচার করারও চেষ্টা থাকে না। মেয়েদের ক্ষেত্রে মুখশ্রী, গায়ের রং, শিক্ষাদীক্ষাই বেশি বিচার্য হয়। পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হলে সেটা আরও বেশি গ্রহণযোগ্য। দেখা যায়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাবামায়ের দৃষ্টি অন্তত এই সমাজে, পাত্রপাত্রীর বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতি, সেই সঙ্গে পেশাজীবনের ‘ডেজিগনেশনের’ প্রতি। ডেজিগনেশনটা অবশ্য পুরষদের বেলায়ই বেশি দেখেন তাঁরা।

বেশিরভাগ মানুষই কেমন ‘দেখিয়ে বেড়ানো’ রোগে আক্রান্ত। চারপাশের আর সকলের চেয়ে আমি কতোটা সেরা, কতোটা আলাদা, কতোটা উপরে সেটি প্রচার করাই যেন সবার উদ্দেশ্য। ছেলেমেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রেও অনেক বাবামায়েরা এই প্রবণতা থেকে মুক্ত থাকতে পারেন না। কতোটা সুদর্শন-সুশ্রী, অবস্থাসম্পন্ন কিংবা ‘ডেজিগনেশন’ধারী পাত্রপাত্রীর সঙ্গে সন্তানের বিয়ে দেয়া গেল এবং আত্মীয়স্বজন-পাড়াপ্রতিবেশীদের সঙ্গে মর্যাদার প্রতিযোগিতায় কতোখানি উপরে থাকা গেল—অনেক রক্ষণশীল পরিবারের অভিভাবকদের এহেন মানসিকতায় বহু ছেলেমেয়ের ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলো মরে ভূত হয়ে যায়। জীবনের একটা বৃহৎ সময় যে মানুষটার সঙ্গে এক ছাদের নিচে বসবাস করতে হবে, তাকে পছন্দ কিংবা অপছন্দ করার অধিকার সেসব পরিবারের ছেলেমেয়েদের খুব একটা থাকে না বললেই চলে। সমাজ, পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজনদের দেখানোর জন্য কেবল বাইরের সৌন্দর্য, বাইরের অবস্থা বিচার করে বাবামায়েরা সন্তানদের ওপর তাঁদের সিদ্ধান্তকে চাপিয়ে দেন নানাভাবে। মানসিকভাবে সন্তানরা তাঁদের সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করতে পারলো কি পারলো না তার খোঁজ রাখেন না কেউ। বলা যায় অনেকাংশে সন্তানরা বাধ্যই হয় পরিবাবের সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে, একটা অচেনা-অজানা মানুষের সঙ্গে স্থায়ী সম্পর্কের পথে হাঁটতে। কিন্তু সম্পর্কটা স্থায়ী হয়ে যাবার পর যদি দেখা যায়, বাবামায়ের পছন্দ করা ব্যক্তিটির মধ্যে বা তার পারিবারিক পরিবেশে বাইরে-ভেতরে বিস্তর ফারাক, বহু অমিল, তখন সন্তানদের জীবনে যে দুর্বিষহ যন্ত্রণা নেমে আসবে, তার অংশীদার কি তাঁরা আদৌ হতে পারবেন? তাঁরা তো চিরকাল থাকবেন না, এমন কি সমাজ, পাড়া-প্রতিবেশী-স্বজনেরাও না। শেষপর্যন্ত ভুক্তভুগী হবে কে?

উল্টো প্রশ্ন দাঁড় করাতে পারেন অনেকে। বলতে পারেন, ছেলেমেয়েদের নিজের পছন্দ করা পাত্রপাত্রীর ভেতর-বাহিরই যে সব সময় একরকম হবে তার নিশ্চয়তা কী? তখন বলতে হয়, জীবনটা যার—লাভ-লোকসান হিসেব করার দায়িত্বটা তার কাঁধেই থাক না। করুণ পরিণতি যদি উপস্থিত হয়ই জীবনে, তবে অন্তত আর কাউকে দায়ী করার প্রয়োজন পড়বে না। আর সময়টা যদি ভালোই যায়, তাহলে বরং পরিবারের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধটা বহুগুণে বেড়ে যাবে এই ভেবে যে, সকলের সমর্থন-সহায়তা পেয়েই জীবনটা এতো আনন্দপূর্ণ হলো।

আবার কেউ কেউ বলতে পারেন, এসব আবেগপ্রসূত কথাবার্তা এক সময় হাওয়ায় মিলিয়ে যায়—দিনশেষে সকলেই সুখে থাকতে চায়, আর বাবামায়েরাও সন্তানদের সুখেই রাখতে চায়। আমি বলি, সাড়ে সাতশো কোটি মানুষের এই পৃথিবীতে সুখের সংজ্ঞাটাও সাড়ে সাতশো কোটি রকম। সবাই-ই যদি সবার সুখ কামনা করে, তবে একের রুচি, পছন্দ-অপছন্দ অপরের ওপর চাপিয়ে দেয়া কেন? সুখের প্রশ্নটা যার জন্য, তার রুচি, তার পছন্দ-অপছন্দটাই বিবেচ্য হওয়া উচিত সব ক্ষেত্রে সবার আগে।

লেখক

লুৎফা বিনতে লকিয়ত