যে আশায় বাঁধি খেলাঘর

যে আশায় বাঁধি খেলাঘর


বেঁচে থাকবার প্রতি লোভটা দিনদিন যতো বেড়েই চলেছে সেই সঙ্গে বেঁচে না থাকবার শতো কারণ শতো অজুহাত আর যৌক্তিক অথচ দুর্বল চেতনাগুলোও পায়ে চলা পথিকের জীবনতরীটিকে বর্ষায় ভরা নদীতে উন্মত্ত জলের প্রবল ঘূর্ণিপাকের মতো নৈরাশ্যের গভীরতম গহ্বরে তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিষয়ী লোকেদের বিষয়শূন্য ভাবনার ঘোর কাটতে যতোটা না কম সময় লাগে, এইসব ছাপোষা হতচ্ছারা বাউণ্ডুলেদের তার চেয়েও অনেক বেশি সময় লাগে নৈরাশ্যের গহ্বরে অজস্র অযাচিত ভাবনার ঘূর্ণিপাকে ঘুরতে ঘুরতে খানিক সময়ের তরে মাথা উঁচিয়ে বাইরের বিচিত্র জগৎটাকে একটুখানি দেখে নেবার। যারা দেখতে পায় তারা হয় মহাকালের আবর্তে চিরঞ্জীব হয়ে ওঠে, না হয় সময়ের স্রোতে কোথায় জানি হারিয়ে যায়, যার হদিস কেউ কোনো দিন দিতে পারে না, দিতে যায়ও না। আর যারা না পারে— নিরেট বেঁচে থাকা মানুষটি হয়েই তারা মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বেঁচে থাকে। বাঁচতে হয় বলেই যেন তাদের বেঁচে থাকা।

সময়টা অন্য সময়ের চেয়ে খারাপ যাচ্ছে বলেই হোক আর নিজের উপর অন্য কারো শাসনের অধিকার না থাকার ফলেই হোক, ঘরের প্রতি পথিক আজ বড্ড বেশি উদাসীন। এরকম ভবঘুরেপনা, জীবনের প্রতি এমন নিরাসক্তি এমন গা-ছাড়া ভাব আগেও ছিলো। কিন্তু এতোটা চোখে পড়ার মতো নয়। পকেট শূন্য থাকলে বরাবরই খিদের জোড় বাড়ে। কিন্তু এখন বাড়ে না। দেহের শক্তি ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে আসলে পা দুটো খুব দ্রুত চলতো, এখন চলে না। সংশয়-সংকটে খুব বাঁচতে ইচ্ছে করতো; আর করে না! আসল কথা কী জানো? সত্যিকারের জীবনের খোঁজে পায়ে চলা পথিক আজ উন্মাদ। যাপিত জীবন কেটেছে না না ঘোরের মধ্যে। আর বর্তমান? সে তো অন্ধকার নগ্ন নির্জন রাতে শ্মশানের ধূলো-বালি আর কালো ছাইয়ের ভেতর মৃত প্রেয়সীর দেহ খুঁজে যাওয়ার মতন। তবুও, সে জীবন জুড়ে কিছু না থাকুক, শূন্যতা ছিলো, আকাশের মতো, মহাসমুদ্রের মতো ব্যাপক-বিস্তৃত শূন্যতা। কিন্তু সে শূন্যতাও যে আজ শূন্য হবার পথে! নিরেট বেঁচে থাকা মানুষটি হয়ে অথবা সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া কেউ হয়ে নয়, পথিক বাঁচতে চায় চিরঞ্জীবের মতো চিরকালব্যাপী। হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে হাঁটতে চায় সে। তাই একটা সত্যিকারের জীবন খুউব দরকার। কোথায় আছে সত্যিকারের জীবন বলতে পারো?

আমি জানি, আমি দেখেছি! শহরের বড়ো রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় গামছা পেতে শুয়ে থাকা বৃদ্ধের ভাজ পড়া কপালে আমি জীবন দেখেছি। আমি জীবন দেখেছি পাবলিক বাসে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ছেঁড়া ব্লাউজ পড়া তরুণীর চিবুক বেয়ে পড়া ঘামের ফোটায়। জীবন দেখেছি ক্যাম্পাসে, টিএসসিতে ছোট্ট ছোট্ট হাতে কয়েকগুচ্ছ মরা গোলাপের পাপড়িতে। আরো দেখেছি রাস্তার পাশে ময়লার ড্রেনে, ডাস্টবিনে কিশোরীর রুক্ষ ময়লা চুল আর শুষ্ক চেড়া ঠোঁটের হাসিতে। জীবন দেখেছি সেদিন; অসুস্থ-রুগ্ন রিক্সাওয়ালার ব্যান্ডেজ লাগানো পায়ে প্রত্যেক প্যাডেলে প্যাডেলে ফুলে ওঠা শিরা-উপশিরায়। জীবন দেখেছি ময়লা ছেঁড়া প্যান্ট পড়া তরুণের আইসক্রীমের বাক্সের ভেতর। চারপাশে অসংখ্য জীবন। কেবল তুমি-আমিই মৃত।

বাঁচতে ইচ্ছে করে। সিডক্সিন আর ফেনাড্রিলের কার্যকারিতা লোপ পেয়েছে অনেক দিন আগেই। নির্ঘুম রাত কাটে অহরহ। পোড়া চোখ আপনিই বুজে থাকে সারা রাত, কিন্তু মস্তিষ্ক জেগে থাকে। বেঁচে থাকবার নেশা বড়ো কঠিন নেশা। এ নেশায় পাপ নেই, অপরাধ নেই। সুখ পেতে ইচ্ছে করে। বেঁচে থাকায় সুখ আছে। বাঁচবো। একটা সত্যিকারের জীবন নিয়ে বাঁচা উচিৎ। জানো তো? কেবল বাঁচতে হবে বলেই বেঁচে থাকা নয়। বরং বেঁচে থাকবার এই সামান্যতম সময়টুকুকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখবার জন্যেই বেঁচে থাকা; বেঁচে থাকবার জন্যে এই জীবন, জীবনের এতো আয়োজন, এতো ঘনঘটা। চলো বাঁচি। বেঁচে থাকবার ইচ্ছেগুলোকেও বাঁচিয়ে রাখি; অনন্তকাল …।