মানুষের খোঁজে
লিলি বিস্কুটের দাম তখন দুই টাকা। আমরা যারা টিফিন পিরিয়ডে স্কুলে যাবার সময় মায়ের দেয়া সবখানি টাকাপয়সা পাইলট স্কুলের সামনে থেকে মামার চটপটি খেয়েমেয়ে শেষ করে ফেলি; আর কিছুমিছু টাকাও থাকে না পকেটে, তারা ছুটির পরে অনেকটা অসহায়ের মতন প্রতিদিন তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরি। ফিরতে ফিরতে কেমন সন্ধ্যে সন্ধ্যে হয়ে যায় আর আমার কেমন ভয় ভয় শুধু করে। কেননা, বেশিরভাগ সময়ই আমি বাড়ি ফিরি একা একা এই জন্যে যে, টিফিনে চুরি চুরি করে বাড়ি ফেরার সাহসটুকুন আমার কোনো দিনই হয়ে ওঠে না। এখন আমি যতোটুকুন বড়ো, সেই সময়, মানে সেই যে বন্যা হয়েছিল আমাদের নুরুর বাড়ির পেছনে, অথবা নল্লার বিলে, সেই যে লোকে বলে দুই হাজার চারের বন্যা, সে সময়; অনেকটুকুন ছোটোই আমি বোধয়, তাই আব্দুলখানা বটগাছের নিচে যেখানে জেলেবাড়ির মরা মানুষদের পুড়িয়ে মারা হতো সেখানটাতে এলেই আমার গা কেমন ছমছম করে। কোনো কোনো দিন ভয় পেয়ে গলা শুকিয়ে যেয়ে কেমন খকখক করে ওঠে; আর আমি কতো পরিচিত মানুষজনকে রাস্তা দিয়ে রিক্সা করে, সাইকেলে করে যেতে দেখে ডেকে ডেকে হয়রান হই, “আমারে লয়া যান”—কেউ তো শোনে না। পরে অনেক করে ভেবে আমি দেখেছি, আমার কথা আমিই শুনি না মোটে। আওয়াজ-মাওয়াজ কিছুমিছু নাই যে গলায়। তাই।
আঙ্গারখোলা গ্যাসলাইনের পরেই একটা ছোটো মতো মজার দোকান। মজা বলতে লিলি বিস্কুট আর সব লজেন্স আর চানাচুর-বাদাম নিয়ে বসে বসে থাকে এক বুড়ো। একদিন অনেকটুকুন ভয় পাওয়ার দিন গলা শুকিয়ে যেতেই দেখি, দূরে সাইকেলে করে পাশের বাড়ির আব্দুল আজিজ মামা যায়। কতো যে ডেকে ডেকে পেছন পেছন দৌড়ে সেই যে আব্দুলখানা থেকে আঙ্গারখোলা পর্যন্ত এলাম, তাও ধরতে পেলাম না। শেষে মজার দোকানের সুপারিখোলের মাচায় বসে বুড়োর কাছে পানি চাইলাম। কিন্তু জানা গেলো, দোকান থেকে কিছুমিছু না কিনলে পানি খাওয়া যায় না। নিয়ম নাই। এ রকম পানি খাওয়ার আফসোস নিয়ে আমি প্রায়ই বাড়ি ফিরি। সন্ধ্যের আগে আগে আমাদের মাটির ঘরের চৌকাঠে বসে ভাত-মাছ-ডাল আর কতো কতো পানি খাই। কতো কতো মজাই না হয় তখন। রাতের বেলা হঠাৎ ঘুম থেকে চিৎকার করে জেগে উঠলে উত্তরপাড়ার হাই মুন্সি নানাকে দেখি কী-মি সব পড়ে-টড়ে একটা কাঁচের গ্লাসে কী স্বচ্ছ পানি, কী সুন্দর টলমলে, ওতে তাবিজ ভিজিয়ে কালো সুতায় বেঁধে আমার গলায় ঝুলিয়ে দেয়। দুদিন গেলেই আমি ভালো হয়ে যাই। জ্বরটর আর কিছুমিছুও থাকে না আর একা একা স্কুলে যাই আর কোনোদিনও ভয়টয় কিছু পাই না আমি। কারণ, আমার মনে হয়, আমি বড়ো হয়ে গেছি; এই জন্যে।
আজকাল বড়ো হয়ে গেছি সত্যিই। শহরের নিরন্তর কোলাহলের মাঝে কিঞ্চিৎ নির্জনতা, নৈঃশ্বব্দকেই যেন আমার ইদানিং ভীষণ আপন আপন লাগে। অগুন্তি স্বার্থের ভিড়ে, বড়ো হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ক্রমশ ছোটো হতে থাকা মানুষদের ভিড়ে, সামান্য একাপনাকেও আজ আমার হাই মুন্সি নানার সূরা-ক্বেরাত পড়ে ফু দেয়া টলমল কাঁচের গ্লাসভর্তি পানির মতন মনে হয়। পাড়ার গোরস্থানের কাছে মিয়ার উদ্দিন মামার সুরেলা কণ্ঠে “কুল্লু নাফসিন যাইক্বাতুল মাউত” কিংবা, নল্লা বিলের পাশে জেলেপাড়ার শ্মশানের “বল হরি, হরি বল” ধ্বনিকে আজকালকার যারপরনাই জ্ঞানে বিদগ্ধ মটিভেশনাল স্পিকারদের স্পিচের চেয়েও কোটিগুণ অমোঘ-অনিবার্য সত্য বলে মনে হয়। স্বপ্নে সত্যের স্পর্শ লেগে ঘুম ভেঙে গেলো আজ মাঝ রাত্তিরে। দেখলাম, পুরনো কবিতার গায়ে ধুলোর আস্তরণ। ঝেরেমুছে কয়েকটা রাত না ঘুমোলে কী-বা ক্ষতি। জেগে রইলাম।
এ শহর—
এক মূর্ছিত নর্তকীর
ধূসর কঙ্কাল জনতার মুখে মুখে
রক্তহীন পচা মাংসের স্তুপ
পদকপ্রাপ্ত মানবতা
মরণোত্তর।
ষোড়শীর আবাদি জমিন
জুড়ে মৃত্যুর প্রকোপ প্রবল
ঊষর ধুলোয় কে ফসল ফলাতে চায়?
বিদগ্ধ সময় কাৎ হয়ে শোয়;
খোঁজে—শূন্য শহর, মানুষ কোথায়?
মানুষ খুঁজতে খুঁজতে যখন ভোরবেলা ঘুমিয়ে পড়লাম, ঠিক তখন, স্বপ্ন না সত্যি বুঝিনি হঠাৎ, ঘুমিয়ে যখন পড়লাম, পাড়ার গোরস্থানে অসংখ্য মৃত মানুষদের পচাগলা লাশের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে থাকলাম; শ্মশানে অসংখ্য মরে পুড়ে যাওয়া মানুষের হাড়গোড়ের ছাইয়ের ভেতর তলিয়ে যেতে থাকলাম; ঠিক তখনই, হ্যাঁ ঠিক তখনই কে একজন মানুষ, ভালো মানুষ, আপন মানুষ, অগুন্তি কথা যার সঙ্গে বলতে পারা যায়, আমৃত্যু পথ যার সঙ্গে চলতে পারা যায়, এমন একজন মানুষ হঠাৎ, হয়তো স্বপ্নে অথবা জেগেই ছিলাম হয়তো; আমাকে ডেকে তুললো। মনে হলো, এ যাত্রা বেঁচে গেলাম।
এখনও বেঁচে আছি। বাঁশতলায় রিক্সায় বসে রোদ পোহাচ্ছি। এ শহরে রাস্তার জ্যামের মতন মানুষের মাথায় সত্যিকারের মানুষের আত্মাটি আটকে থাকে অযাচিত জটিল সব চিন্তার জটের ভেতর। অতো চিন্তা করে কী হয়?