বুদ্ধি বেচে ভাত কিনে খায় যারা

বুদ্ধি বেচে ভাত কিনে খায় যারা


রবিন গাইবান্ধার ছেলে। তার বাবা ভাত বেচে বুদ্ধি কিনে খাওয়া চাষবাস করা লোক। ফলে সংসার চলে কর্দমাক্ত খানাখন্দ ভরা মেঠো পথে, বুড়ো বলদে টানা গাড়ির মতো। ধীরে। হেলেদুলে। রবিনের আচরণে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণী অধ্যাপকদের লক্ষণ দেখতে পাই বলে ভাব জমানোর লোভ সামলাতে পারি না। মাঝে মাঝে আমি বিশেষ দিনগুলোতে মৌন ব্রত পালন করি। দিন যায়, রাত যায়। কারও সঙ্গে কথা বলি না। মুখে অন্তত না। বাইরে বের হবার প্রয়োজন হলে লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় ইশারা-ইঙ্গিতে অথবা চিরকুটে। রবিনের সান্নিধ্য পাওয়ার ইচ্ছে হলো মনে।

রেস্টুরেন্টে আমার সামনের চেয়ারেই বসেছে রবিন। পকেট থেকে রুমাল বের করে হাতমুখ মুছতে যেয়ে তার মনে হলো, এটা ঢাকা শহর। এবং সে একটা ভালো মানের ‘হোটেলে’ খেতে এসেছে। কাজেই টিস্যু ব্যবহার করাটা ভদ্রতা অথবা তার অধিকার। রবিন হাতমুখ মুছতে টিস্যুর একটা অংশ ব্যবহার করেছে। আর একটা অংশ রুমালের মতো ভাজ করে বুক পকেটে রেখেছে।

খাবার এলো। বরবটি ভর্তা, লাউ সবজি, ডাল। খাওয়া শুরুর আগে রবিন পানি পান করেছে। সম্ভবত তার ধারণা, বড়ো খাবার হোটেলে ঠান্ডা পানির বোতল রেখে দেয়া হয় টেবিলে। যার প্রয়োজন সে পান করে। রবিন আমার কেনা কিনলের বোতল থেকে নির্দ্বিধায় পানি পান করেছে। ওয়েটারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো বিধায় দরকারের চেয়ে বেশি যত্ন-আত্তি আমি এই রেস্টুরেন্টে পেয়ে থাকি। ওয়েটার যথেষ্ট দায়িত্বের সঙ্গে পানির বোতলটি যে আমার ব্যক্তিগত সম্পদ তা রবিনকে অত্যন্ত তিরস্কারের সঙ্গে বুঝিয়ে দিল। কৃশকায় তরুণীর চুপসে যাওয়া পাণ্ডুর বুকের মতো রবিনের মুখটি দেখে আমার দুঃখ হলো।

কথা বলা বারণ। কেননা মৌন ব্রত চলছে। কিন্তু বেশিক্ষণ মৌন থাকা গেল না। একটা ভাতের বাটি রবিনের পাতে ঢালতে যেয়ে ওয়েটার কিছু ভাত নিচে ফেলে দিয়েছে। তৎক্ষণাৎ রবিনের হাহাকার আমাকে মুগ্ধ করলো। “আহা হা একি করলেন, একি করলেন, ভাত ফেইলি দিছেন!”

রবিনের সঙ্গে আলাপ জমে উঠেছে। প্রসঙ্গ—ভাত। তার মতে, ভাত সরাসরি খোদার দান। এটা নষ্ট করলে ইহকালে-পরকালে যারপর নাই দুঃখ ভোগ করতে হয়। ভাত নষ্ট হলে রবিনের কষ্ট হয় প্রচণ্ড। তার কান্না পায়। কিন্তু পুরুষ মানুষের কাঁদতে বারণ। কারণ, কান্না মনকে দুর্বল করে দেয়। দুঃখ-যন্ত্রণা কান্নায় ধুয়ে যায় ঠিকই, তার সঙ্গে ধুয়ে যায় যুদ্ধ করার সাহসটুকুও। রবিন একজন তরুণ যোদ্ধা। দারিদ্র্য থেকে মুক্তিলাভের প্রশিক্ষণ নিতে সে গ্রাম থেকে শহরে এসেছে কিছু দিন হলো। যুদ্ধ করার কায়দাকানুন কিছুটা রপ্ত হলে আবার সে গ্রামে ফিরে যাবে।

কথায় কথায় রবিনের পরিবার সম্পর্কে জেনেছি। বাবা-মা, দুই ভাই আর এক বোন মিলে পাঁচ জনের সংসার। বড়ো ছেলে হওয়ায় রবিনের দায়িত্ব অনেক। মাথা ভালো না। তাই পড়াশোনা হাই স্কুলের মাঝামাঝি পর্যন্ত। ভাইটা পড়াশুনায় ভালো। তাকে ঘিরেই পুরো পরিবারের যাবতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা। কলেজে পড়ছে। ‘সেগেনিয়ার’। সায়েন্স বিভাগ। বিয়ে করেছে কিনা—প্রশ্নের জবাবে রবিন যা জানালো, তার অর্থ এই—ভাইটার একটা গতি হওয়ার আগ পর্যন্ত বিয়ে সে করবে না। সবার ইচ্ছে, ‘ইনিভার্সিটি’তে পড়ে তার ভাই একদিন অনেক বড়ো কিছু একটা হবে। ‘কী’ হবে তা সে জানে না। তবে, হবে। তার আগে ঢাকা থেকে গ্রামে ফিরেই রবিনের প্রথম কাজ বোনের বিয়ে দেয়া। বোনটা তার মতোই গাধা। এবার আই-এ ফেল করেছে। দুই বিষয়ে। চেহারা ভালো হওয়ায় বিয়ের সম্মন্ধ আসছে অনেক জায়গা থেকেই। ভালো ‘ফেমিলি’ পেলে বিয়ে দিয়ে দেবে। কিন্তু মুশকিল হলো, পাঁচেপদে মেলানো যায় না। আজকাল ভালো ‘ফেমিলি’, ভালো ছেলে একসঙ্গে পাওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার। খালি টাকাপয়সা থাকলেই তো হয় না।

এঁটো হাতে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি। রবিনের কথা শুনছি। তার খাওয়া দেখছি। খাওয়া শেষে তার প্লেট, হাত একদম ধুয়ে ফেলার মতো চকচকে মনে হলো। রবিন চা পান করে না। সুযোগ পেলে ধূমপান করে। ফলে আমরা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করেছি। আমার সঙ্গে কথা বলে রবিনের ভালো লেগেছে। তাই তার বোনের বিয়েতে আমাকে সে দাওয়াত করতে চায়। সিগেরেটের ধোঁয়ায় ল্যাম্পোস্টের আলো ঝাপসা দেখাচ্ছে। ঝাপসা আলোয় রবিনের বোনের মুখ দেখতে পাই। ব্যক্তিগতভাবে আমি ‘ভালো ছেলে’ কিনা; ভালো ‘ফেমিলি’র কিনা প্রশ্ন জাগে মনে। উত্তর আসার আগেই রবিন বিদায় নিতে চায়। তাকে যেতে হবে অনেকটা দূর। যাবার আগে ফোন নম্বর নিয়ে যায়। তার ভাইয়ের জন্য দোয়া করতে বলে, যেন তার ভাইটাও আমার মতো ‘ইনিভার্সিটি’তে পড়ে ‘ভালো লোক’ হতে পারে।

‘ভালো লোকে’র তকমা গায়ে জড়িয়ে আমি ঘরে এসে শুয়ে পড়ি। ফেসবুকের নিউজফিড ঘাটি। আবরারের ছবি দেখি। অনেক রকম খবর পড়ি। বুদ্ধি বেচে যারা ভাত কিনে খায়, সে সব বুদ্ধিজীবী লোকেদের আলোচনা শুনি। রবিনেরা আবরার বোঝে না, ‘ইনিভার্সিটি’ চেনে না। সব কেবল রূপকথার গল্পের মতো জানে। রবিনদের জানাগুলো চিরকালের সত্যি কবে হয়ে উঠবে এই ভাবনা নিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে পড়লে আমি স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নে রবিনের বোনকে নিয়ে আমি হাতিরঝিলে হাঁটতে যাই। রবিনের বোনেরা হাতিরঝিল চেনে না। হাত ধরতে জানে না।