প্রাণের পুরুষ

প্রাণের পুরুষ


“ক্ষমা করো মোরে সখী, শুধায়ো না আর—
মরমে লুকানো থাক মরমের ভার।।”

সাগর সেনের কণ্ঠে রবিঠাকুরকে শুনতে শুনতে আজ আমার সঙ্গে হেঁটে আসলাম অনেকটা দূর। মানুষের ভিড়েই বোধয় মানুষ সবচেয়ে বড়ো আড়াল খুঁজে পায়। নির্জন-নিভৃতে নয়, অজস্র মানুষের কোলাহলেই প্রকৃত নিঃশব্দের খেলা; সে খেলা খেলতেই আজ আমার সঙ্গে হেঁটে আসলাম অনেকটা দূর। মর্মে-মর্মে পাহাড়ের মতো যে বোঝা বইতে না-পারার যন্ত্রণার কথা কইতে পারা গেলো না এতো কাল, সে যন্ত্রণাটুকুন যেন আজ নিঃশব্দের তানপুরা সেধে হঠাৎ গাইতে শুরু করে দিলো।

“যে গোপন কথা, সখী, সতত লুকায়ে রাখি
ইষ্টদেবমন্ত্রসম পূজি অনিবার ।
তাহা মানুষের কানে ঢালিতে যে লাগে প্রাণে—
লুকানো থাক তা, সখী, হৃদয়ে আমার।।”

ধুলো-মাটির জগতের অনুভূতিগুলো কেমন তেলচিটচিটে হয়ে আমাদের এখন-তখনকে অমন কাদা-কাদা ক’রে দিয়েছিলো। আবেগের দোকান খুলে যারা হাসি বেচে, কান্না বেচে; মৃত্যুকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে হাজার বছর বাঁচতে পারার কায়দা যারা শেখায়, তাদের মোহ থেকে, মায়া থেকে আজ তবে আমরা দু’জন মুক্ত হলেম। ঝিঁঝিটের অর্ধঝাঁপে পরস্পরের জন্ম-জন্মান্তরের না-কওয়া কথাটুকুন জানা হলো অবশেষে। আজ সহস্র মানুষের ভিড়ে তাই একান্তে-নিভৃতে আমার সঙ্গে হেঁটে আসলাম অনেকটা দূর।

“ভালোবাসি, শুধায়ো না কারে ভালোবাসি ।
সে নাম কেমনে, সখী, কহিব প্রকাশি ।
আমি তুচ্ছ হতে তুচ্ছ—সে নাম যে অতি উচ্চ,
সে নাম যে নহে যোগ্য এই রসনার।।
ক্ষুদ্র এই বনফুল পৃথিবীকাননে
আকাশের তারকারে পূজে মনে মনে—
দিন-দিন পূজা করি শুকায়ে পড়ে সে ঝরি,
আজন্ম-নীরবে রহি যায় প্রাণ তার।।”

প্রাণের পুরুষ। আমাদের পৌরুষ ওড়ে শাদা ধোঁয়া হয়ে বাতাসে। আমাদের অস্পৃশ্য নিঃশ্বাসে বিষাক্ত জগৎ পাশ ফিরে শোয়; গল্প জমে না ব’লে ঘুমিয়ে পড়ে এক সময়। আমি আর আমি, আমরা দু’জন, আজ তাই এক সঙ্গে হেঁটে আসলাম অনেকটা দূর, সহস্র মানুষের ভিড়ে, সকলের অলক্ষ্যে, নির্জনে বড়ো গোপনে। হেঁটে আসলাম অনেকটা দূর।