করোনার দিনে : ধর্ম ও বাস্তবতা
সবচেয়ে যা ভালোবাসার বস্তু বা বিষয়, তা মানুষ অসৎ উদ্দেশ্যে কিংবা অবৈধ পন্থায় ব্যবহার করতে পারে না—এ সত্য চিরকালের। ধর্মকে বহু মানুষ ভালোবাসতে পারেনি, ভয় করতে পেরেছে। কেউ কেউ মানুষের সেই ভয়কে অনৈতিকভাবে নিজের স্বার্থে কাজে লাগাতে পেরেছে। ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ বিশ্বাসপ্রবণ হয়। অযৌক্তিক-অবৈজ্ঞানিক বহু বিষয়ের ওপর ভয়ার্ত মানুষের বিশ্বাস জন্মায় সহজেই। ফলে ধর্মের প্রতি ভালোবাসাহীন, ভয়পাওয়া মানুষগুলো ধর্মপ্রাণ হওয়ার পরিবর্তে হয়ে উঠেছে ধর্মভীরু; বহু মিথ্যে-বানোয়াট সংস্কারকে ধর্মের সঙ্গে মিশিয়ে অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে করতে হয়ে উঠেছে ধর্মান্ধ। পৃথিবীর জঘন্যতম জনপ্রিয় ব্যবসায়ের মধ্যে অন্যতম হলো ধর্মব্যবসায় যার পুঁজি এই অযাচিত ভয় আর অন্ধ বিশ্বাস। এই ব্যবসায়ের ব্যবসায়ী এবং খদ্দের হয়ে এ দেশের একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী ঠকানোর ও ঠকে যাওয়ার চর্চা করে আসছে বহুকাল ধরে। এতোকালের চর্চা সরকারের অল্প কদিনের শাসন-শিক্ষায় ভণ্ডুল হয়ে যাবে—এ ভাবনা অমূলক। ফলে বিশ্বব্যাপী মহামারী আকার ধারণ করা করোনা ভাইরাস যে ধার্মিক-অধার্মিক, ধনী-দরিদ্র আর সহায়-অসহায় চেনে না, তা এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বোঝানো কঠিন। বলা বাহুল্য, ধর্মব্যবসায়ীদের চেয়ে ধর্মখদ্দেররা সংখ্যায় হাজারগুণে বেশি। করোনার বিস্তার রোধে এই হাজারগুণে বেশি ধর্মখদ্দের সম্প্রদায়কে সচেতন করে তুলতে মাথায় হাত বোলানো হোক আর আচ্ছামতো ঠ্যাঙানো হোক, ধর্মভয় আর বিশ্বাস তাদের অটুট-অক্ষয়ই থেকে যাবে। এদের সচেতন করার একমাত্র উপায় হতে পারে সেই সব ধর্মব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা এবং জনসম্মুখে ক্ষমা চাওয়ার ব্যবস্থা করা, যারা ধর্মীয় আলোচক কিংবা ধর্মগুরু সেজে প্রতিনিয়ত সাধারণ আবেগী মানুষদের ভয়-বিশ্বাসকে পুঁজি করে ব্যবসা করে যাচ্ছে, নানা রকম গুজব রটিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে। পাশাপাশি ধর্মকে যাঁরা সত্যিকারভাবে ধারণ করেন, চর্চা করেন আর ধর্ম সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন এবং যাঁরা শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ রয়েছেন তাঁদের কর্তব্য হবে সহজ ও যৌক্তিকভাবে বুঝিয়ে-শুনিয়ে ধর্মান্ধ ও ধর্মভীরু সম্প্রদায়কে ধীরে ধীরে ধর্মপ্রাণ করে তোলা, ধর্মের প্রতি তাদের ভয় নয়, অন্ধবিশ্বাসও নয়—ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করা। মনে রাখা প্রয়োজন, কেবল নিজে সচেতন হয়ে নিরাপদে থেকে করোনার মহামারী থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়। কেননা ধর্মীয় গোড়ামি আর অজ্ঞানতার বশবর্তী হয়ে যারা সরকার ও প্রশাসনের বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে আইন লঙ্ঘন করছে, নিজেরা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে, তারা এই সমাজ এই রাষ্ট্রেরই অধিবাসী; আপনার-আমার ঘরের লোক, আত্মীয়স্বজন কিংবা প্রতিবেশী। দিনশেষে এদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। তাই নিজে সচেতন থাকার পাশাপাশি এই মানুষগুলোকে সচেতন করে তোলার দায়িত্বও আমাদের নিতে হবে। তা না হলে করোনা যদি সত্যি সত্যিই আমাদের এই দেশটাকে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করে তবে এদের সঙ্গে সঙ্গে আমাকে-আপনাকেও বিনা হিসাবে জাহান্নামে যেতে হবে—সন্দেহ নাই।