অস্তিত্ব

অস্তিত্ব


অনেক দিন আগে, সন্ধ্যার খানিক পরে; ঝিমুচ্ছিলাম বারান্দায় কাঠের চেয়ারটাতে বসে। বাইরে ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি, আবছা অন্ধকারের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুতের চমকানিতে বেশ ভূতুরে অথচ ভালো লাগার মতন একটা পরিবেশ যদিও হয়ে উঠেছিল; দেড় বছরের আদরের ছোট্ট বোন মাহিতার এ-ঘর ও-ঘর ছুটোছুটি আর হৈ-হুল্লোরে সে ভৌতিকতার যৌক্তিকতা হারিয়ে গেলো নিমেষেই। চোখ লেগে এসেছিল; হঠাৎ তীব্র আর্ত-চিৎকারে তন্দ্রা ভেঙে গেলো। চোখ খুললাম—চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিচ্ছুটি দেখবার জো নেই। হাতরিয়ে কোনো রকমে পাশের ঘরে গেলাম। অন্ধকারে শোনা গেলো কেবল ছোট্ট দু’টি পায়ের থপাথপ শব্দ আর ভয়ার্ত কণ্ঠে প্রবল চিৎকার—“আমি কই! আমি কই”!

কী আদ্ভুত প্রশ্ন! আলো জ্বালাবার আগ পর্যন্ত কান্না থামে নি। বিদ্যুৎ-বিভ্রাট কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়; তবে সেদিনকার ব্যাপারটা ছিল বড়ো তাৎপর্যময়। ছোট্ট মুখে ছোট্ট একটা প্রশ্ন সেই যে আমার সমস্ত ভাবনা জুড়ে ভয়ানক ভূতুরে একটা বসতি গেড়ে বসলো, তাতে না গেলো শান্তিতে বাস করা; তাকে না গেলো পুরোপুরি উচ্ছেদ করা। প্রতিটা মুহূর্তে মুহূর্তে প্রতিটা দেয়ালে দেয়ালে সেদিন থেকে কেবল সেই একটা কথাই প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো—“আমি কই! আমি কই”!

জয়নাগ রোডের শেষ মাথার নীল রঙা বাড়ীটায়, রোজ কতো অতিথি আসে। চকচকে গাড়ীর গ্লাসের ভেতর দিয়ে তাকালে কতো তরুণীর লাল ঠোঁট দেখা যায়। সন্ধ্যায় গানের জলসা বসে ছাদে। পথে দাঁড়ালে তাদের উচ্ছাস শোনা যায়। আমি দাঁড়াই নি কখনো; কখনো দাঁড়াই না। রাস্তার পাশের ডাস্টবিনটায় যেখানে কাক আর মানুষেরা কানামাছি খেলে সারাবেলা, যেখানে জীবন্ত কৃমিদের বয়ে নিয়ে চলা শিশুটি চিরে যাওয়া ঠোঁট আর লাগামের ঘা-কে উপেক্ষা করে বিকট শব্দে চিৎকার জুড়ে দেয়, যেখানে ছেঁড়া কামিজের নীচে তরুণীর ফুসকুড়ি ওঠা কুৎসিত বুক দেখা যায়—সেখানে দাঁড়াই আমি। নীল রঙা বাড়ীটার ছাদে এক সময় নানা আলোর বৃষ্টি ঝরে। আকাশ-মাটি বিদীর্ণ করা ইলেকট্রিক গিটারের অসহ্য মেলোডি, ড্রামের ধুপ-ধাপ, আতশবাজির ধ্রুম-ধ্রামকে ছাপিয়ে আমার সমগ্র চিত্ত জুড়ে তখন কেবলই বাজতে থাকে সেই একটাই প্রশ্ন—“আমি কই! আমি কই”!

শহুরে আত্মকেন্ত্রিক টিকটিকিদের বড়ো অচেনা লাগে। নিজ হাতে বানানো চিনি ছাড়া চায়ের কাপে প্রবল আস্থার চুমুক টিকটিকিদের ঘরোয়া আলাপে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে ভেবে বেলকুনিতে বসে ঝিমুই। বাইরে ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি, আবছা অন্ধকারের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুতের চমক ভূতুরে ভালো লাগার মতন পরিবেশ তৈরি করে না আর। সহস্র লোকের হাঁকাহাঁকি, রিক্সার বেল, গাড়ীর হর্ন তবুও চাপা পরে আমার ভাবনার পরতে পরতে আষ্টে-পিষ্টে-লেপ্টে থাকা সেই একটাই প্রশ্নের নীচে—“আমি কই! আমি কই”!

প্রশ্নই শুধু আছে; উত্তর জানা নেই।