অরূপের প্রতি
শার্টের সবগুলো বোতাম খুলে ঘরে না ফেরা ভবঘুরে মতন কেউ কেউ যখন সন্ধ্যেবেলার ব্যস্ত- আলোকিত শহরের কোনো এক নির্জন পথে ল্যাম্পোস্টের আধো- আলো আধো- আঁধারের মাঝে দাঁড়িয়ে পাখির ডানার মতো দু’পাশে দু’হাত ছড়িয়ে দেয়; আর আকাশের দিকে তাকিয়ে ক’ফোটা বৃষ্টির প্রতীক্ষায় চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ানো খুড়িয়ে চলা সময়ের আদ্যোপান্ত অনায়াসে ভুলে যায়; তখন মনোজগতে কাল- বোশেখীর প্রচণ্ড ঝড়ের সঙ্গে প্রবল বর্ষণে ভাবনার উঠোন ভিজে একাকার হয় সত্য, কিন্তু সেই ঘরে না ফেরা ভবঘুরে মতন কারো কারো ধূলোমাখা পা এতোটুকু ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে ওঠে না কখনো। কেননা, বৃষ্টি আসে না।
তবুও বৃষ্টি ঝরার কেমন মাতাল করা মিষ্টি শব্দের কথা মনে করে করে ঘরে না ফেরা পায়ে চলা পথিক ঘরে ফেরার গান ধরে। সন্ধ্যার ব্যস্ত শহর যখন মধ্যরাতের স্তব্ধ- শান্ত- স্থির রুগ্ন মানুষটির মতন অবসাদের সমস্ত রস ঢেলে দিয়ে গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে, তখনও তার গান থামে না। শহরের প্রত্যেকটি দেয়ালে- দেয়ালে, অলিতে- গলিতে সে গানের করুণ সুর প্রতিধ্বনিত হয়। সে সুর অভদ্রপল্লির কোনো এক প্রদীপ নেভানো গৃহে রমণীর আচমকা অট্টহাস্য অথবা দূরে কোথাও অন্ধকারে রিক্সার ক্রিং ক্রিং বেলের শব্দ কিংবা রাস্তার পাশে ময়লার ড্রেইনে মরে বেঁচে থাকা ভেজা ইঁদুরের ক্ষীণ আকুতিকে ছাপিয়ে যায় না হয়তো। কিন্তু তবুও, নেতিয়ে পড়া অনুভূতি গুলো ধীরে ধীরে সজীব হয়ে ওঠে সে গানের সুর শুনেই। সে সুরের মূর্ছনাতেই থমকে দাঁড়ানো খুড়িয়ে চলা সময় বুড়িয়ে যাওয়া ভাবনা আর অসহায় কল্পনার ভাঙা গাড়িটিকে ঠেলে নিয়ে চলে ভবিষ্যতের দিকে।
তারপর ভবিষ্যৎ নামক ভয়ংকর অলীক- অবাস্তব অথচ যৌক্তিক ধারনাটিকে মাথায় নিয়ে পায়ে চলা পথিক যখন যাবতীয় দুঃখ- কষ্ট- যন্ত্রণা সমূহকে উদযাপন করবার অভিপ্রায়ে ভেতরে ভেতরে অনুভূতির বেশ একটা জমকালো আয়োজন করে ফেলে, তখন চারপাশের সবকিছু ধীরে ধীরে কেমন সরে সরে যেতে শুরু করে তার থেকে। রাত যতো গভীর হয়, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব পথিকের মস্তিষ্কে ততো পরিস্কার হয়ে ধরা দেয়। আর বেলাশেষে ঘরে না ফেরা পথিক অনুভব করে— কায়ার সঙ্গে ছায়া হয়ে মর্তলোকের কেউ থাকুক আর না-ই থাকুক, স্বর্গলোকের কেউ একজন সর্বদাই থাকেন। আত্মার ভেতর পরমাত্মা হয়ে, রূপের মাঝে অরূপের রূপ ধরে তিনি সব সময়ই বর্তমান থাকেন মনুষ্যলোকে। আগুন- পানি- বাতাস- মাটিতে গড়া পুতুলের যতো ইচ্ছে- অনুরাগ, আশা- অভিমান, যতো ভুল- পাপ, মোহ- মায়া আর যতো অভিযোগ— দিনশেষে সকল কিছু শোনার মতন শ্রোতা কেবল তিনিই একজন। এই বিশাল- বিস্তৃত ভূমণ্ডলে ভবঘুরে মতন কেউ কেউ যখন দু’পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবার মতো এতোটুকুন স্থান খুঁজে পায় না, তখন এমনতর আশ্রয়হীনের একমাত্র এবং সর্বশেষ আশ্রয়দাতা যে শুধু তিনিই।
কেবল একটি বোতাম খুলে পড়ে যাওয়ার দরুণই হোক আর হালের খানিক স্পর্শ গায়ে মাখবার জন্যেই হোক; শার্টের সবক’টা বোতাম খুলে রেখে ব্যস্ত শহরের পথে পথে একাকী হেঁটে চলার রহস্য যে কী তা যাঁর অজানা নয় তাঁর কাছেই আজ ঘরে না ফেরা ভবঘুরে পথিকের প্রাণের আকুতি— ‘পথ দেখাও হে পরমেশ্বর, আমি আজ বড়ো বেশি ক্লান্ত; আমায় ঘরে নিয়ে চলো’।