আপনার আমি
একজন পথেঘাটের রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার অনেক দিনের আলাপ। অনেক দিন আমরা একসঙ্গে এখানে-ওখানে বসে থেকেছি, কথা কয়েছি, এটা-ওটা খেয়েছি; তারপর একরকম না বলে-কয়েই যে যার পথে চলে গিয়েছি। আমাদের কখনো বাধেনি।
বাধলো সেদিন।
২৩তম জন্মদিনটি পালন করতে যেয়ে তাঁর সঙ্গে আমার আচ্ছামতো কাট্টি হয়ে গেলো। আয়োজন তেমন ছিলো না, তবুও আমার সাধ্যের তুলনায় ঢের। সব গেলো জলে। আমার জন্মদিনের একমাত্র অতিথিটি নিমন্ত্রণ রক্ষা করলেন না। এমনকি পরে বুঝতে পারলাম আমাদের বিগত দিনের এতো সব চলাচল্তি-ওঠাবসার স্মৃতিও তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন। হয়তো আমাকেও। দুঃখ পেলাম।
বহু বছর পূর্বে জগদ্বিখ্যাত কবি রবীন্দ্রনাথ “পৃথিবীতে কে কাহার” বলে আমার ভাবলোকে যে দুর্বোধ্য ভাবের প্রণোদনা দিয়েছিলেন, এতোকাল পরে একজন পথেঘাটের রবীন্দ্রনাথ সে ভাবের বস্তুজাগতিক রূপটি দেখিয়ে দিলেন। আমি যেন এক নূতন কিছু পেলাম। সত্যিই তো—‘পৃথিবীতে কে কাহার’! মানুষ নিজেই যখন নিজের নয় তখন পরকে আপন জানবার এতো কেন ছল? এতো কীসের মিছেমিছি আপনেপনা?
জটিল রহস্য। এ রহস্যের জট খুলতে একদিন ঘটা করে বসে পড়লাম টিএসসি-শাহবাগ রোডের পাশে একটা যাত্রীছাউনিতে। উদ্দেশ্য—জীবন দেখা। বিচিত্র সব মানুষ, বিচিত্র মানুষের চালচলন, কথাবার্তা, অঙ্গভঙ্গি। কারো সঙ্গে কারো মিল নেই, অথচ কেউ যেন আলাদা কেউ নয়। অদ্ভুত জীবন সব।
আমার ভাবের ঘোরে ছেদ পড়লো এক সময়। কোত্থেকে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে এসে আমার পাশে হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে বসে পড়লেন। বোঝা গেলো, বেশ হেঁটে এসেছেন। সঙ্গে ছেলেমেয়ে, স্ত্রীগোছের একজনকেও দেখা গেলো। সুখী পরিবার; বোধয় ঘুরতে বেড়িয়ে থাকবেন।
বেশ খানিকক্ষণ আড়চোখে চোখাচোখি হবার পর হাসিহাসি মুখ করে তিনিই প্রথম কথা পারলেন।
— কী ভাবছেন অতো একা একা বসে?
আমি বললাম, ‘একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি’।
— ‘কী প্রশ্ন’? তিনি জানতে চাইলেন।
চারপাঁচ বছরের একটি মেয়েশিশু তার মায়ের সঙ্গে কী নিয়ে যেন তর্ক করছিল। আমি তাকে দেখিয়ে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম,
— ঐ বাবুটি আপনার কে হয়?
— আমার ছোটো মেয়ে।
— ব্যাডমিন্টন হাতে ঐ ছেলেটা?
— আমার ছেলে। একটাই।
— আর ঐ যে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছেন, উনি?
— বড়ো মেয়ে, অনার্সে ভর্তি হলো এবার। পাশে আমার ওয়াইফ। হাউজ ওয়াইফ, হা হা হা।
ভদ্রলোক হেসে হেসে বেশ কৌতুকপূর্ণভাবে উত্তর দিয়ে গেলেন। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি?
— শিক্ষকতা করছি।
— না, আমি জানতে চাচ্ছিলাম আপনি আপনার কে হোন।
এবার একটু ভরকে গেলেন তিনি।
— এটা আবার কেমন প্রশ্ন?
মহাশয় চিন্তায় পড়েছেন। তাঁর বড়ো মেয়ের চোখ দু’টো বইয়ের পাতা থেকে আমার দিকে ঘুরে আসতে আসতে আমি দ্বিতীয়বারের মতো তাঁকে প্রশ্নটা বুঝিয়ে বললাম। হাউজওয়াইফ তাঁর ছোটো মেয়ের সঙ্গে তর্কে ব্যস্ত।
— এরা সবাই তো আপনার কেউ না কেউ হয়; আপনি আপনার কে হোন, কী হোন আমি তা-ই জানতে চাচ্ছি।
ভদ্রলোক উপরের ঠোঁট কামড়ে ধরে অবোধ অপরাধী ছাত্রটির মতো আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে হলো, জীবনে প্রথমবারের মতো একজন শিক্ষককে বোকা বানাতে পারা গেলো। এঁরাও তাহলে বোকা হয়! অথচ আমরা কিনা…
একটা গম্ভীর চেহারা নিয়ে আচমকা উঠেই আমি দ্রুতপায়ে হাঁটতে শুরু করলাম। পিছু ডাকতে ডাকতে অনেকদূর এসেছিলেন তিনি। আমি একবারের জন্যেও ফিরে তাকাইনি।
ফেরার পথে হাকিমচত্বরে পথেঘাটের রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেলো একবার। কী কটাক্ষ, কী বিদ্রূপভরা তাঁর চাহনি! আমি দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস করিনি। যতোই সামনে এগুচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিলো স্বোপার্জিত স্বাধীনতার সামনে কনসার্টের মাইক থেকে কেবল তাঁরই অট্টহাসি ভেসে আসছে। তিনি চেঁচিয়ে বলছেন—
— “ওহে অকালপণ্ডিত নাবালক যুবক, যে প্রশ্নের পূর্বাপর তুমি নিজেই জানো না, অথবা জানলেও ঠিকঠাক বোঝো না, অথবা নিজে বুঝলেও কাউকে বুঝাইতে পারো না; তাহার উত্তর জিজ্ঞাসা করিয়া অন্যকে বিব্রত করা কেন? জগৎটা কি তোমার ফাইনাল পরীক্ষার ভাইভাবোর্ড, নাকি মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের কনে দেখবার আসর”?